মঙ্গলবার, ১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সুন্দরবনের কাঁকড়া রপ্তানি আয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা : তিন বছরে দ্বিগুণ !

সুন্দরবনের কাঁকড়া রপ্তানি আয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা : তিন বছরে দ্বিগুণ !

এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্ব ঐতিহ্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের  মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাত বঙ্গোপসাগরেবিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় কাঁকড়া রপ্তানি খাতে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৭০০ কোটি টাকার কাঁকড়া রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে, যা তিন বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ।
সফটশেল ও হার্ডশেল কাঁকড়ার চাষ ও রপ্তানির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানও বেড়েছে। বর্তমানে দেশের ২.৫ থেকে ৩ লাখ মানুষ এই খাতে সরাসরি নিয়োজিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চিংড়ির তুলনায় কাঁকড়ার চাষে ঝুঁকি কম, রোগবালাইও তুলনামূলকভাবে কম, এবং সফটশেল কাঁকড়ার আন্তর্জাতিক চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে।
খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে এই সম্ভাবনাময় খাতকে ঘিরে বৈদেশিক আয় আরও বাড়াতে সরকার ও বিনিয়োগকারীদের কার্যকর ভূমিকা রাখা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। উপকূলের তিন বছরের ব্যবধানে দেশে কাঁকড়া রপ্তানি আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। গত অর্থবছরে বিদেশে কাঁকড়া রপ্তানি করে ৭০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। তিন বছর আগে আয় হয়েছিল ৩৯৪ কোটি টাকা। সফটশেল ও শক্ত খোলসের কাঁকড়া রপ্তানিতে দেশে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। একই সঙ্গে কাঁকড়ার চাষ দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা চিংড়ির বিকল্প হিসেবে কাঁকড়া রপ্তানির মাধ্যমে ডলারসংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। ফ্রোজেন ও জীবিত কাঁকড়া বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করা হয়। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারা দেশে ৯ হাজার ৭৮৮ দশমিক ৭২ টন কাঁকড়া রপ্তানি করে ৬ কোটি ২৮ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯১ ডলার আয় হয়েছে। আগের বছর ৭ হাজার ৪৫২ দশমিক ১৫ টন কাঁকড়া রপ্তানি করে ৪৪৫ দশমিক ১৯ কোটি টাকা আয় হয়েছিল। ঢাকা থেকে ৯ হাজার ১৪৩ টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে, যেখানে খুলনা অঞ্চল থেকে সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানির মাধ্যমে ৮০ লাখ ২১ হাজার ৯২৪ মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। তবে গত তিন বছরে সফটশেল কাঁকড়ার রপ্তানি ২৫৭ দশমিক ৯৪৫ টন কমেছে।
এ কারণে রাজস্ব আয়ও হ্রাস পেয়েছে। পল্লি কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, সারা দেশে ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ লাখ মানুষ কাঁকড়া চাষে নিয়োজিত। সাতক্ষীরায় ৩০ হাজার মানুষ এ কাজে জড়িত। কক্সবাজার, পটুয়াখালী, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ বাড়ালে সরকারের রাজস্ব আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি হতে পারে। বাংলাদেশে ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ম্যাডক্র্যাব বা শিলা কাঁকড়ার চাষ হয়। এ কাঁকড়া জীবদ্দশায় ১৪-১৬ বার খোলস বদল করে। নরম অবস্থায় অর্থাৎ সফটশেল কাঁকড়া হিসেবে রপ্তানি করা হয়। বর্তমানে কক্সবাজার ও সাতক্ষীরায় কাঁকড়ার হ্যাচারি রয়েছে। পল্লি কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চিংড়ির তুলনায় কাঁকড়ার চাষে ঝুঁকি কম ও পুষ্টিগুণ বেশি।’ তিনি আরও জানান, কাঁকড়ার ব্যবসা ঝুঁকিমুক্ত ও রোগবালাই কম। তাই কাঁকড়ার চাষ ও রপ্তানি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। কীভাবে হয় কাঁকড়ার চাষ: বাগদা চিংড়ির মতো কাঁকড়া উপকূলীয় লবণাক্ত পানিতে চাষ করা হয়। তাই দেশের উপকূলীয় অঞ্চল কাঁকড়া চাষের জন্য উপযোগী। নরম দো-আঁশ বা এঁটেল মাটিতে কাঁকড়া চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে এই কাঁকড়া চাষ হয়। উপকূলীয় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ ও সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় শিলা কাঁকড়ার দেখা মেলে। তবে খুলনা ও চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় এদের সংখ্যা বেশি।
সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে, বিশেষ করে হরিনগর, মুন্সীগঞ্জ ও নয়াদিঘির এলাকায় বেশি পরিমাণ কাঁকড়া চাষ করা হয়। সাতক্ষীরার মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলার ৩২১ হেক্টর এলাকায় কাঁকড়া চাষ হয়। বছরে দুই হাজার টনের বেশি কাঁকড়া উৎপাদিত হয়। নদীর মোহনা বা সাগরের জোয়ারের পানির সঙ্গে বিভিন্ন আকারের কাঁকড়া আসে; এর মধ্যে ছোট বা কিশোর কাঁকড়া সংগ্রহ করে ঘেরে রেখে বড় করা হয়। বড় কাঁকড়া হলে ওইগুলো ধরে বিক্রি করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে পালনের ক্ষেত্রে কাঁকড়ার খাবার হিসেবে তেলাপিয়া বা অন্য ছোট মাছ ব্যবহার করা হয়। চিংড়ির তুলনায় কাঁকড়া চাষে সময় কম লাগে এবং কাঁকড়ার রোগ-বালাইও চিংড়ির তুলনায় কম। খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মিল্টন সর্দার জানান, কাঁকড়ার পোনাকে ক্র্যাবলেট বলা হয়। একসময় এগুলো উপকূলীয় এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হতো, এখন হ্যাচারিতে পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে দুইভাবে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে।
একটি হচ্ছে ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজাকরণ ও অন্যটি হচ্ছে সফটশেল কাঁকড়া উৎপাদন। মোটাতাজাকরণে একটি জলাশয় জাল বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘিরে কিশোর কাঁকড়া পালন করা হয়। এভাবে কাঁকড়া একটি নির্দিষ্ট ওজন পর্যন্ত বড় হলে তা বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ঘেরে চাষের পাশাপাশি হার্ডশেল কাঁকড়া বিভিন্ন নদ-নদীতেও পাওয়া যায়, ওইগুলো সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে সফটশেল কাঁকড়া চাষে প্লাস্টিকের বাক্সে ৮০ বা ১০০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া রাখা হয়। নিয়মিত খাবার দেওয়ার মাধ্যমে কাঁকড়া বড় করা হয়। যেহেতু কাঁকড়া খোলস পাল্টায়। তাই কাঙ্ক্ষিত ওজনের হলে খোলস পাল্টানোর সময় কাঁকড়া ধরা হয়। এ সময় কাঁকড়ার খোলস না থাকার কারণে এটি নরম হয়, তাই একে সফটশেল ক্র্যাব বলা হয়। বিদেশে সফটশেল কাঁকড়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকা মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে সফটশেল ও শক্ত খোলসযুক্ত কাঁকড়া রপ্তানি প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাঁকড়া রপ্তানিতে বড় একটি সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগ করলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।’

Views
CATEGORIES
Share This